বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

রাশিয়ার সঙ্গে ‘সীমাহীন' বন্ধুত্বের সীমা টানতে চায় চীন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৭ অক্টোবর ২০২৪ |

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ঠিক আগে, চীন অনেক ধুমধাম করে রাশিয়ার সঙ্গে ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ ঘোষণা করেছিল। প্রস্তাব করেছিল ভবিষ্যতে বাণিজ্য, শক্তি এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। এরপর যুদ্ধের দুই বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। সময়ের সঙ্গে বিকশিত হয়েছে এই ‘সীমাহীন’ প্রতিশ্রুতির অর্থ ও ব্যাখ্যা।

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় মস্কোর সঙ্গে বেইজিংয়ের পথচলা নিয়ে চীনা সমাজে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ রাশিয়ার সঙ্গে আরও আনুষ্ঠানিক জোটের পক্ষে কথা বলেছেন। তবে অন্যরা আরও সতর্ক অবস্থান নেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। ২০২২ সালের তুলনায় চীনের সতর্কতা বাড়ছে। এসব আলোচনা নিয়ে বাধানিষেধও যেন শিথিল এখন। ২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়ার আক্রমণের বিরোধিতাকারী ছয় চীনা ইমেরিটাস ইতিহাসবিদের একটি যৌথ চিঠি সরকার সেন্সর করেছিল। সতর্কও করা হয়েছিল সেই পণ্ডিতদের।

তবে এখন মনে হচ্ছে, চীন সরকার রাশিয়া ও পশ্চিম—উভয়ের সঙ্গেই তার সম্পর্কের ভারসাম্য আনতে চাইছে। বেইজিং মনে হয় এই যুদ্ধের এক ‘নির্ধারক’ শক্তি হিসেবে নিজেকে হাজির করতে চায় না। উদাহরণস্বরূপ, গত মে মাসে চীন-রাশিয়ার যৌথ বিবৃতি থেকে ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্ব শব্দটি নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

মে মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সফর নিয়ে বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয় রকম হিসাবি। পুতিন যখন বলছেন যে শি তাঁর ‘ভাইয়ের মতো ঘনিষ্ঠ’, তখন শির প্রতিক্রিয়া ছিল কেমন ভাসা–ভাসা। তিনি পুতিনকে বললেন ‘ভালো বন্ধু ও একজন ভালো প্রতিবেশী’। বিশ্লেষকেরা রাশিয়ায় চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সম্পর্কে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। আর তা প্রকাশ্যেই।

সাংহাইয়ের ফুদান ইউনিভার্সিটির চীনা নিরাপত্তাকৌশলের একজন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত ডিং লি বলেছেন, চীন ইউক্রেন বা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে রাশিয়ার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না। ডিং লি ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত ফু কংয়েরও উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্ব কথার অলংকার ছাড়া আর কিছুই নয়।

আগস্টে সুদূর পূর্ব রাশিয়া সফরের সময় পুতিন চীনকে ‘মিত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এরপর চীনা পণ্ডিতেরা অবিলম্বে এই বিবৃতি নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলেন। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক জোট যে নেই, এ কথাই তাঁরা স্পষ্ট করতে চাইছিলেন। এই চীনা পণ্ডিতদের বিবৃতি কিন্তু কেবল কথার কথা নয়। সরকার-অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নেতৃস্থানীয় চীনা পণ্ডিতেরা সরকারের অবস্থান ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য প্রচারক হিসেবে কাজ করেন। ফলে তাদের কথা বেইজিংয়ের কৌশলগত মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

চীন ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্বের সীমা পুনর্বিবেচনা করছে

রাশিয়া-চীন একসঙ্গে পথচলা পুনর্মূল্যায়নের কয়েকটি উপাদান রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সংশয়। গত বছর ওয়াগনার গ্রুপ বিদ্রোহ করল। এরপর রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের অনুপ্রবেশ ঘটল। এর পর থেকে রাশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে বেইজিংয়ে পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি রাশিয়ায় যুদ্ধবিরোধী মনোভাব কী অবস্থায় আছে, তা নিয়ে নিয়েও বিবেচনা করছে চীন।

ফেং ইউজুন ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া অধ্যয়নকেন্দ্রের পরিচালক। তাঁর মতে, ওয়াগনার বিদ্রোহ ছিল রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং দেশীয় নিরাপত্তাগত সমস্যার প্রতিফলন। ইতিহাসে দেখা গেছে, যতবারই রাশিয়া অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, তার শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা গেছে কমে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস রয়েছে। তাইওয়ান নিয়ে সংঘাতে রাশিয়া কখনোই চীনকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তেমনি চীনও ইউক্রেনের যুদ্ধে জড়িত হওয়া এড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি ফেং ইউজুন আরও স্পষ্টভাবে ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয়ের পূর্বাভাস দিয়েছেন। তাঁর মতে, চীনের উচিত মস্কো থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং ‘নিরপেক্ষ, সংঘাত নয়’ নীতি অব্যাহত রাখা।

দ্বিতীয়ত, চীনের মন্থর অর্থনীতি ও রাশিয়ার সঙ্গে তার অপ্রতুল বাণিজ্য আবার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে উভয় দেশই পশ্চিমের ওপর কতটা নির্ভরশীল। রাশিয়া-চীন বাণিজ্য ২০২৩ সালে ২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এটা একটা রেকর্ড। তবে এ বছরে তা মন্থর হয়ে গেছে। কারণ, চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ার সঙ্গে সংযোগ সীমিত করার চেষ্টা করছে। এই বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে রাশিয়া থেকে আমদানি করে থাকে চীন। চীনের বাণিজ্যের মাত্র ৪ শতাংশ রাশিয়ার কাছ থেকে আসে। আর রাশিয়ার বাণিজ্যের প্রায় ২২ শতাংশ আসে চীনের কাছ থেকে।

অনেক চীনা বিশেষজ্ঞ এখন রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত আমদানি–নির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে সতর্ক করছেন। তাঁদের মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা আরও বাড়ানো রাশিয়া চীনের কাছ থেকে বেশি সুবিধা পেতে একটি দর–কষাকষির জন্য তার প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছে—এমন একটা উদ্বেগের ধ্বনি এমনিতেও শোনা যাচ্ছে।

সামরিক মিত্র হিসেবে রাশিয়ার মূল্য

চীনের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি রাশিয়ার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না—এমন একটা ভাবনা চীনে ক্রমেই দানা বাঁধছে। সাংহাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক ঝাও লং বলেন, রাশিয়া আর চীনের বিশ্বকে দেখার ভঙ্গির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। সেটা কী? রাশিয়া নতুন করে গড়ে তুলতে বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। আর চীন বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে আরও বিশিষ্ট স্থান দখল করে একে রূপান্তরিত করতে চায়।

বেইজিংয়ের রেনমিন ইউনিভার্সিটির কৌশলবিদ শি ইয়িনহং বলেন, চীন-রাশিয়া আরও শক্তিশালী জোট গড়ে ওঠার পথে একটা বড় বাধা আছে। তাঁর মতে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস রয়েছে। তাইওয়ান নিয়ে সংঘাতে রাশিয়া কখনোই চীনকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তেমনি চীনও ইউক্রেনের যুদ্ধে জড়িত হওয়া এড়িয়ে গেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। আর সামরিক মিত্র হিসেবে রাশিয়ার মূল্য কতটা, তা নিয়ে চীনে ক্রমে প্রশ্ন উঠছে।

ফেং ইউজুন সম্প্রতি বলেছেন, রাশিয়া চীনের শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার নেতৃত্বে চীনের কোনো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ইতিহাসে চীন যতবারই রাশিয়ার সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করেছে, ততবারই এর পরিণতি চীনের জন্য হয়েছে নেতিবাচক। তাই ফেং ইউজুনের মতে, পশ্চিমের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ককে দুর্বল না করে রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব বজায় রাখা চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বর্তমান প্রতিযোগিতা থেকে লাভ হয়েছে রাশিয়ার। রাশিয়া এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে চেয়েছে। কিন্তু এর ফলে চীন-রাশিয়া সম্পর্কেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor